এপোলো ১২ (পর্ব-১)
Mission Apollo XII (Logo) |
United States চন্দ্রাভিযানে এপোলো ১১ পাঠানোর পরপরই আরেকটা অভিযানের পরিকল্পনা করে রেখেছিল। ১৯৬৯ সালে জুলাই মাসের ১৬ তারিখে চাঁদের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়া এপোলো ১১ এর উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের মাটিতে মানুষের পদচিহ্ন রাখা সম্ভব, তা প্রমাণ করা। নাসা'র বিজ্ঞানীরা শুধু এতটুকুতেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। আরো বিস্তর গবেষণা করার জন্য তারা চাঁদে এপোলো ১২ পাঠানোর পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন।
মিশন এপোলো ১২ পরিচালনার উদ্দেশ্য
- চাঁদের 'Ocean of Storm' বা ঝড়ো সমূদ্রে অবতরণ করা (এপোলো ১১, চাঁদের 'Ocean of tranquillity' বা শান্ত সমূদ্রে অবতরণ করেছিল)।
- চাঁদের মাটিতে ৩১.৫ ঘন্টা অবস্থান করে হেঁটে বেড়ানো (এপোলো ১১ এর ক্ষেত্রে দুই ঘণ্টা বত্রিশ মিনিট ৪০ সেকেন্ড)।
- Surveyor 3 (১৯৬৭ সালের এপ্রিল থেকে চাঁদে) রোবোটটিকে দেখে আসা।
নভোচারী
Crews of Apollo XII |
এপোলো ১২ এর জন্য নাসার বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়াররা কাজে লেগে গেলেন। ট্রেনিং চলাকালীন সময়েই এপ্রিলে (১৯৬৯) তিনজনকে এপোলো ১২ এর জন্য মনোনীত করা হয়। তারা হচ্ছেন
- Charles "Pete" Conrad (কমান্ডার),
- Richard F. Gordon (কমান্ড মডিউল পাইলট)
- Alan L. Bean (লুনার মডিউল পাইলট)।
এপোলো ১২ এর প্রস্তুতি
পুরোদমে প্রস্তুতি ও কাজ চলতে থাকলো। সবকিছু মাপ-জোখ করা। তাই চমৎকারভাবেই কাজ এগুচ্ছে। কিন্তু এপোলোর সার্ভিস মডিউলের জ্বালানী ট্যাংকে তরল হাইড্রোজেন রাখার সময় বিপত্তি দেখা দিল। টেকনিশিয়ান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন ট্যাংকের ইনসুলেশন সিস্টেম কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই হাইড্রোজেনকে তরল রাখার মতো পর্যাপ্ত ঠান্ডা তাপমাত্রা (-252.87 °C) ধরে রাখতে পারছে না। কর্মকর্তারা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, এপোলো ১৩ এর সার্ভিস মডিউল এখানে লাগিয়ে দিবেন। এপোলো ১২ এর ঝামেলা আপাতত মিটে গেল।
উৎক্ষেপণ, নভেম্বর ১৪, ১৯৬৯
President Nixon |
মার্কিন প্রেসিডেন্ট Richard M. Nixon, ফার্স্ট লেডি Pat Nixon, ভাইস-প্রেসিডেন্ট Spiro T. Agnew (১৯৬৯ এর আগস্ট থেকে National Space Council এর Executive Secretary ছিলেন), নাসা'র তত্ত্বাবধায়ক Thomas O. Paine, নভোচারী Frank Borman এবং এপোলো ৮ এর দুইজন নভোচারী James A. lovell ও Willium A. Andres এপোলো ১২ উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। মহাকাশযান উৎক্ষেপনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে উপস্থিত থাকার সর্বপ্রথম রেকর্ড Nixon এর।
সকাল ৬ টায় নভোচারী অফিস প্রধান Thomas P. Stafford এর ডাকে নভোচারী তিনজনের ঘুম ভাঙে। নাস্তা করেন। সাথে Stafford, এপোলো মহাকাশযান প্রোগ্রাম ম্যানেজার James A. McDivitt, ব্যাকআপ লুনার মডিউল পাইলট James B. Irwin, ব্যাকআপ লুনার মডিউল পাইলট-২ Charles J. "Chuck" Tringali এবং ক্রু সাপোর্ট দলনেতা একত্রে নাস্তা করেন। নভোচারীদের স্পেস স্যুট পরিয়ে ক্রু মেম্বাররা Launce Pad 39A তে নিয়ে যায়। তারপর তাদেরকে কমান্ড মডিউলে ঢুকানো হয়। বামপাশে Conrad, ডানপাশে Bean এবং মাঝখানে Gordon কে বসানো হয়। কমান্ড মডিউলের দরজা বন্ধ করে দেয় কর্মীরা। উৎক্ষেপনের পূর্ব পর্যন্ত নভোচারীত্রয় দুই ঘন্টা সময় পান সবকিছু দেখে নেয়ার জন্য।
অবশেষে ১৪ই নভেম্বর, ১৯৬৯ এর মেঘাচ্ছন্ন বৃষ্টিস্নাত একটি দিন, সকাল ১১ঃ২২ (EST) এ এপোলো ১২ উৎক্ষেপণ করা হয়। Saturn V SA-507 রকেট এপোলো ১২ কে বহন করে। তারপর Kennedy Space Center এর ইঞ্জিনিয়াররা হোস্টনে অবস্থিত Mission Control Center (MCC) [বর্তমানে এটি Johnson Space Center] এর কাছে মহাকাশযানটির নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করে। MCC তে ফ্লাইট পরিচালক Gerald D. “Gerry” Griffin এর Gold Team মিশনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। উৎক্ষেপণকালে MCC থেকে Capcom (Capsule Communicator) হিসেবে Gerald P. “Jerry” Carr নভোচারীদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেন। MCC দর্শক গ্যালারী থেকে এপোলো ১১ এর নভোচারী Neil A. Armstrong ও Edwin E. “Buzz” Aldrin উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করেন। উৎক্ষেপণের প্রথম ছত্রিশ সেকেন্ড সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। Conrad এর ভাষায়, “It’s a lovely liftoff. It’s not bad at all!”
বজ্রপাত
Lightning Strike |
এপোলো ১২ মেঘ চিড়ে উড়ে যাচ্ছে। ৬,৬০০ ফুট উচ্চতায় যাওয়ার পর বজ্রপাত হয় এর উপর। নিচ থেকে দর্শকরা দেখলেন Launce Pad এর উপর বজ্রপাত হয়েছে। Conrad শুধু উজ্জ্বল আলোর একটা ঝলক দেখলেন। তারপর তিনি বুঝতে পারলেন মহাকাশযানটির অধিকাংশ ইলেকট্রনিকস যন্ত্র কাজ করছে না। বজ্রপাতে বিদ্যুৎ সরবাহকারী তিনটি ব্যাটারির একটিও কাজ না করায় এ বিপত্তি ঘটে। সৌভাগ্যক্রমে Saturn V রকেটের কোনো ক্ষতি হয় নি। ইতিমধ্যে মিশন কন্ট্রোলের মনিটরগুলো হাবিজাবি দেখানো শুরু করেছে।
৫২ সেকেন্ডে মহাকাশযান পরিচালনা সহায়ক সিস্টেম বন্ধ হয়ে যায়। ফ্লাইট পরিচালক Griffin তরুন ইঞ্জিনিয়ার John W. Aaron এর সহায়তায় মহাকাশযানের অবস্থা বুুুুঝতে পেরেছিলেন। Aaron তার আগের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী অনুমান করে যে আরো একবার বজ্রপাত হওয়ায় মহাকাশযান পরিচালনা সহায়ক সিস্টেম বন্ধ হয়ে যায়। Aaron সমাধান দিলেন, সুইচ নরমাল অবস্থান থেকে সহায়ক অবস্থানে সরালে সিস্টেম পুনরায় কাজ করতে পারে। Griffin নির্দেশ দিলেন Carr কে এপোলো ১২ তে যোগাযোগ করতে। Carr এর নির্দেশনা অনুুুুযায়ী Bean সুুুইচ ঠিক করে দেয়। কয়েক সেকেন্ড পর মনিটরে সঠিক ডেটা দেখানো শুরু করে। তারপর আর কোনো অঘটন ঘটে নি।
ইঞ্জিন রম্য
সাড়ে এগার মিনিট পর এপোলো ১২ পৃথিবীকে প্রায় বৃত্তাকার অরবিটে (118 by 115 mile) প্রদক্ষিন করে। পরবর্তী আড়াই ঘন্টা এপোলো ১২ মহাকাশযান রকেটের তৃতীয় ধাপ S-IVB এর সাথে সংযুক্ত থেকে পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। সবাই নিশ্চিত করেন যে সবকিছু ঠিকঠাক কাজ করছে।
Mission Control Center (MCC) থেকে জানানো হয়, “The good word is you’re Go for TLI.” (TLI- Trans Lunar Injection). Conrad একটু উত্তেজিত, “Hoop-ee-doo! We’re ready! We didn’t expect anything else!" ব্যস! রকেটের
S-IVB এর single J-2 ইঞ্জিন পাঁচ মিনিট চুয়াল্লিশ সেকেন্ড চালানো হয়। এপোলো ১২ প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৩৮,৮৫৮ কি.মি. গতিতে যেতে থাকে (তাত্ত্বিকভাবে পৃথিবীর মুক্তিবেগ প্রতি ঘন্টায় ৪০,৩২০ কি.মি.)।
এর ২৫ মিনিট পর এপোলো ১২ প্রায় ৬,৯২০ কি.মি. উচ্চতায়, রকেটের S-IVB ধাপ থেকে Command & Service Module (CSM) আলাদা করা হয়। Gordon আস্তে আস্তে CSM কে S-IVB ইঞ্জিন থেকে আলাদা করার জন্য Lunar Module (LM) এর দিকে ঘুরায়। LM এর intrepid (LM এর একটি প্রান্ত অংশ) তারপরও S-IVB ইঞ্জিনের মাথায় লেগে ছিল। তাই Conrad বলেন, “I got an awful pretty looking Intrepid sitting out the window here, gang. We'll go get her.” নভোচারীরা ক্যামেরা চালু করে দেখালেন সে দৃশ্য। এপোলো ১২ এখন প্রায় ২০,৯২২ কি. মি. উপরে। এখান থেকে পৃথিবীকে একটা বাস্কেট বলের মতো দেখা যায়।
S-IVB ইঞ্জিনের আচরণ এমন যে, চাঁদে সে যেতে চায়। এপোলোকে কোনো ডিস্টার্ব করবে না! ২০ মিনিট পর দ্বিতীয়বার চেষ্টা করে তারা ইঞ্জিনটিকে Intrepid থেকে আলাদা করতে পারে।
মহাশূন্যে ঘুম
নভোচারীরা খেতে বসলেন। উৎক্ষেপণের পর এটাই প্রথম খাবার। ফ্লাইট পরিচালক M.P. “Pete” Frank এর Orange Team ও নভোচারী Edward G. Gibson নতুন Capcom হিসেবে মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রন নেয়ার পর নভোচারীত্রয় স্পেস স্যুট খুলে ফেলেন। S-IVB ইঞ্জিনের এমন আচরণে হিসাব ঠিকঠাক রাখার জন্য পরিচালকরা প্রথম mid-course correction (MCC-1) বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। Conrad এবং Bean দুজনে Lunar Module (LM) পর্যবেক্ষণ করার জন্য দরজা খুলে বের হলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন Interpid শক্তভাবে আটকে আছে। পর্যবেক্ষণ শেষে তারা ফিরে এলেন। মহাকাশে ঘুমানোর জন্য তাদের প্রথম রাত। Conrad বললেন Mission Control এ উৎক্ষেপণের সময় তাদের যে কথাবার্তা হয়েছে, তার রেকর্ড যাতে ঘুমানোর সময় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে বাজানো হয়। Clifford E. “Cliff” Charlesworth এবং তার Green Team ও Don Lind নতুন Capcom হিসেবে এপোলো ১২ এর নিয়ন্ত্রণ নিলে সবাই ঘুমাতে গেলেন। তারা ১,৪৪,০০০ কি. মি. এর বেশি পথ পাড়ি দিয়েছেন।
তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় Mission Control এ আরো একটি দল পরিবর্তন হয়। ফ্লাইট পরিচালক Griffin এবং সাথে নতুন Capcom হিসেবে Paul J. Weitz নিয়ন্ত্রন বুঝে নেন।
দ্বিতীয় দিন
ঘুম থেকে উঠার পর আরো একদিন পুরোদমে কাজ করার জন্য নভোচারীরা উদ্দীপিত। পৃথিবী তাদের থেকে ২,০১,১৬৮ কি. মি. দূরে। নাস্তা করে নিল তারা। তারপর দ্বিতীয় Midcourse Correction (MCC-2) চালানো হয়। MCC-2 হচ্ছে System Module (SM) এর দ্বিতীয় firing Service Propulsion System (SPS) ইঞ্জিন, চাঁদে সঠিক উচ্চতার অরবিটে নিয়ে যাবে। Conrad দেখেন পৃথিবীকে একটা Golf ball এর মতো। দ্বিতীয়বার ঘুমানোর আগে তারা পৃথিবী থেকে প্রায় ২,৬৫,৫৪২ কি. মি দূরত্বে।
তৃতীয় দিন
তৃতীয়দিন ঘুম থেকে জাগার পর তারা পৃথিবী থেকে প্রায় ২,৯৭,৭২৯ কি. মি দূরত্বে। সকালে খাওয়ার সময় তারা Weitz এর কাছ থেকে খবর ও খেলার স্কোর জেনে নেয়। Weitz আরো জানায় MC তৃতীয় Midcourse Correction (MCC-3) না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এপোলো ১২ চাঁদের কাছাকাছি চলে এসেছে। নভোচারীরা জানাল যে চাঁদের একটা বড় অংশ অন্ধকারে থাকায় তারা এর খুবই অল্প অংশ দেখতে পাচ্ছে। তারা সরাসরি সম্প্রচারে দেখাল তা।
CM এর বামপাশের জানালা দিয়ে পৃথিবী, মাঝখানের জানালা দিয়ে সূর্য এবং ডানপাশের জানালা দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তারা অর্ধচন্দ্রাকার চাঁদ ও অর্ধচন্দ্রাকার পৃথিবীর কিছু চমৎকার ছবি তুলে পাঠায়। তারপর নভোচারীরা ঘুমাতে যায়। ততক্ষণে এপোলো ১২ চাঁদের অভিকর্ষ বলের প্রভাবে চাঁদের দিকে এগুতে শুরু করে।
Crescent Moon |
Crescent Earth |
চতুর্থ দিন
চতুর্থ দিনের মতো তারা ঘুম থেকে উঠে। এখন তারা চাঁদ থেকে মাত্র ২৫,২২০ কি. মি দূরত্বে এবং চাঁদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফ্লাইট পরিচালক Glynn S. Lunney সিদ্ধান্ত নিলেন যে MCC-4 প্রয়োগে যতটুকু বেগ পরিবর্তন হবে, তা এত সামান্য যে Lunar Orbit Insertion (LOI) দিয়ে পুষিয়ে দিবেন। যেহেতু নভোচারীরা চাঁদের অন্ধকার অংশে চলে গিয়েছে, তারা সৌর-আলোকমণ্ডল (Solar Corona) ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। (LOI) প্রয়োগের জন্য মহাকাশযানটিকে সঠিক অবস্থানে ধরে রাখতে হবে। কিছুক্ষণ পর এপোলো ১২ চাঁদের পিছনে চলে যায় এবং অন্যান্য মিশনের মতো পৃথিবীর সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ত্রিশ মিনিট পর তারা ছয় মিনিটের জন্য (LOI-1) প্রয়োগের জন্য SPS ইঞ্জিন চালায়। এতে এপোলো ১২ এর বেগ কমে যায় এবং উপবৃত্তকার কক্ষপথে (194 miles by 72 miles) চাঁদকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। হোস্টনে মিশন নিয়ন্ত্রক ও পরিচালকরা উদ্বিগ্ন হয়ে এপোলো ১২ এর সিগন্যালের অপেক্ষায়। যদি ইঞ্জিন সঠিকভাবে চালু হয়, তাহলে ৩২ মিনিট পর তারা সিগন্যাল পাবে। আর ইঞ্জিন চালু না হলে ৭ মিনিট আগেই সিগন্যাল চলে আসবে।
[চলবে....]
John Uri
NASA Johnson Space Center
রুপান্তর ও সম্পাদনাঃ Tushar Siddik
Reference: NASA
No comments:
Post a Comment