-->

Welcome here

Confirmed
Deaths
Recovered
Updated:
  • Bhawal to Gazipur (Tale of a Palace)

    ভাওয়াল থেকে গাজীপুর
    (রাজবাড়ি কথন)

    Bhawal Rajbari
    Bhawal Rajbari
    ভাওয়াল জমিদার পরিবার জমিদারির একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত জয়দেবপুর গ্রামে বাস করতেন। তাঁদের বাড়িটি রাজ বাড়ি নামে পরিচিত। প্রায় ১৫ একর জমির উপরে নির্মিত ৩৬০ টি কক্ষ বিশিষ্ট প্রাসাদের মূল আসবাব পত্রের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, প্রতিটি কক্ষে এখন সরকারী দপ্তরের কক্ষ যদিও দ্বিতল রাজবাড়ির কাঠামো এই শতবর্ষেও আছে অপরিবর্তিত, ঐতিহ্যবাহী মেহগনি ও শাল কাঠের সিঁড়ি আছে এখনো অক্ষত।

    জয়দেবপুরের রাজবাড়ি রেলস্টেশনের পূর্ব পাশে। রাজবাড়ির সামনের দিকের রাস্তাটির নাম ছিল রাজবাড়ি রোড। রাজপরিবারের কোন লোকের মৃত্যু হলে তার মৃতদেহ দাহ করা হত চিলাই নদীর পাশে, নির্দিষ্ট শ্মশানে। চিলাই নদীতে স্নানের জন্য রাজ পরিবারের লোকজন ব্যবহার করতেন একটি নির্দিষ্ট স্নানের ঘাট। এই স্নানের ঘাটটির নাম ছিল ‘শিকদার’ ঘাট।

    রাজবাড়িতে প্রবেশ করতে গেলে প্রথমেই পড়ত বড় দালান। এই দালানে অবশ্য রাজপরিবারের কোন লোকজন বসবাস করতেন না। বড় দালানে থাকতেন রাজবাড়ির অতিথিরা। রাজবাড়ির অতিথি হয়ে যারা জঙ্গলে শিকার করতে আসতেন তাঁরা এই বড় দালানে উঠতেন। তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল এই বড় দালানে। অবশ্য কিছু পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল ১৯০২ সালের পর থেকে।

    এই সময় মিঃ মেয়্যার রাজ এস্টেটের ম্যানেজার নিযুক্ত হয়ে জয়দেবপুর রাজবাড়িতে এসে উঠেছিলেন। তিনি বড় দালানটিকে তাঁর নিজের বাসসস্থান হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। বড় দালানের পিছনেই ছিল ‘নাটমন্দির’। এই নাটমন্দিরের দুই পাশেই ছিল ঝুল বারান্দা। এই ঝুল বারান্দা ছিল নাটমন্দির ঘিরে দু-পাশের দালানে। এই দোতালা বাড়ির ঝুল বারান্দা থেকে রাজপরিবারের মহিলারা নাটমন্দিরে অনুষ্ঠিত যাত্রা, থিয়েটার প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলি দেখতেন। গান-বাজনা হলে এখানে বসেই তাঁরা সেই সব শুনতেন। বাড়ির একটি ঘরকে ব্যবহার করা হত ঠাকুরঘর হিসেবে। ঠাকুরঘরটিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল জগদ্ধাত্রীর মূর্তি (বিগ্রহ)। জগদ্ধাত্রী পূজা উপলক্ষে প্রতি বছর নাটমন্দিরে গান-বাজনার আসর বসতো। এছাড়াও প্রতি বছর নাটমন্দিরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো। একাধিক উৎসব পালন করা হতো জয়দেবপুর রাজবাড়িতে। ভাওয়াল এস্টেটের প্রজারা রাজবাড়ির উৎসবগুলিতে যোগদান করতেন। উত্তর দিকের বাড়ির দোতলার একটি ঘর ছিল রাজবাড়ির সদর বৈঠকখানা।

    এই বাড়ির পিছনের দিকে ছিল রাজবাড়ির অন্দর মহল। অন্দর মহলটিকে বলা হতো পুরানো বাড়ি। পুরানো বাড়ির পশ্চিমদিকের অংশটিকে বলা হতো পশ্চিমাখণ্ড। রাজবাড়ির পুরুষদের সাহেব-সুবাদের সাথে মেলা-মেশা থাকলেও মেয়েরা ছিলেন পর্দানশীন। রাজবাড়ির অন্দর মহলে বাইরের পুরুষদের প্রবেশাধিকার ছিল না। রাজবাড়ির পিছনের দিকে খোলা অংশে ছিল একটি বাগান। পূর্বদিকে চিলাই নদী। পশ্চিমদিকে ছিল একটি বড় দীঘি। রাজবাড়ির মেয়েরা মাধব বাড়ির পাশ দিয়ে পশ্চিমের দীঘিটিতে যাতায়াত করতেন।

    ‘মাধব বাড়িতে’ ছিল ‘রাধামাধবের’ মূর্তি। ‘রাধা মাধবের’ মূর্তিটি ছিল পাথরের। মাধব বাড়ির পিছনে ছিল রাজবিলাস। রাজা কালি নারায়ণের মৃত্যুর পর রাজপরিবারের লোকজন সাধারণত বাস করতেন রাজাবিলাসে। জয়দেবপুর রাজবাড়িতে ছিল ডাক্তারখানা, খাজাঞ্চিখানা, ফরাসখানা, বাবুর্চিখানা প্রভৃতি। রাজবাড়ির ইউরোপিয়ান অতিথিদের জন্য ছিল একজন অহিন্দু পাচক। এ ছাড়া বাইরের দালানে ছিল ছবিঘর।

    রাজবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই ছিল পোলো খেলার ময়দান। এছাড়াও রাজবাড়িতে ছিল ‘দেওয়ান খানা’। রাজবাড়ির কাছেই ছিল এম-ভি স্কুল। পরে অবশ্য স্কুলটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল ‘রাণী বিলাসমণি স্কুল’। স্কুলটির বোর্ডিং হাউসটি ছিল স্কুলবাড়ির দক্ষিণদিকে। রাজবাড়ির সন্নিকটে রেল লাইনের পাশে প্রতি সপ্তাহের সোমবার এবং শুক্রবার হাট বসতো। রাজবাড়ির চত্বরে ছিল ঘোড়াশালা এবং হাতিশালা। পিলখানার পাশাপশি ছিল মাহুতদের থাকার বাসসস্থান।

    মেজোকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ যখন ১৯০৯ সালে দার্জিলিং ভ্রমণে গিয়েছিলেন, সেই সময় রাজবাড়ির হাতিশালে ছিল ১৩টি হাতি। প্রত্যেকটি হাতির ছিল আলাদা আলাদা নাম।

    ঢাকার বুড়িগঙ্গার পাশে নলগোলায় ভাওয়ালরাজের একটি বাড়ি ছিল। কুমারেরা ঢাকায় এলে নলগোলার বাড়িটিতে উঠতেন। রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যুর পর কুমাররা খুব ঘন ঘন ঢাকার নলগোলার বাড়িতে যাতায়াত করতেন। ভাওয়াল রাজের ‘মতিয়া’ নামে একটি লঞ্চ ছিল। বুড়িগঙ্গায় বাঁধা থাকতো লঞ্চটি। ঢাকায় এলে কুমাররা এই ‘মতিয়া’ নামক লঞ্চে করে ঘুরে ফিরে বেড়াতেন। এ ছাড়াও ভাওয়ালরাজের ছিল একাধিক নৌকা।

    ১৯১৭ সালের ভূমি জরিপ ও বন্দোবস্ত রেকর্ডে দেখা যায় যে, ভাওয়াল রাজ পরিবারটি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ২২৭৪টি মৌজায় ৪,৫৯,১৬৩.৩০ একর জমির মালিক হয়েছিলেন। ভাওয়াল রাজ এস্টেটের প্রদত্ত হিসেব থেকে দেখা যায় ১৯০৪ সালে ভাওয়াল রাজের জমিদারির ভূমি রাজস্ব বাবদ সরকারকে প্রদান করা হয়েছিল ৮৩,০৫২ টাকা এবং সকল খরচ-খরচা বাদে নিট আয় হয়েছিল ৪,৬২,০৯৬ টাকা।

    বাংলদেশের অধিকাংশ জমিদার তাঁর জমিদারি এলাকায় বসবাস করতেন না। রাজা নিজেই জমিদারি পরিচালনা করতেন। সনাতনীভাবে বেশিরভাগ বড় জমিদার তাঁদের জমিদারি ব্যবস্থাপনার জন্য নির্ভর করতেন নায়েব, গোমস্তা, পিয়াদা, পাইকের উপর। আর জমিদারগণ করতেন কোলকাতা কেন্দ্রিক বিলাসী জীবন যাপন। এক্ষেত্রে ভাওয়াল জমিদার পরিবার ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারির ব্যবস্থাপনা ছিল সুদৃঢ় এবং দক্ষতাপূর্ণ। ভাওয়াল রাজ স্বহস্তে জমিদারি পরিচালনা করতেন এবং প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে জমিদারি সেরেস্তায় বসতেন।

    সম্পূর্ণ জমিদারিটি ভাওয়াল রাজ কয়েকটি সার্কেলে বিভক্ত করেছিলেন। প্রতিটি সার্কেল একজন মফস্বল নায়েবের উপর ন্যস্ত ছিল, যাকে একজন তহশিলদার, মুহুরি, জমাদার, পিওন, ঝাড়-দার এবং কুলি সাহায্য করতো। এ ছাড়াও তার অধীনে থাকতো একদল লাঠিয়াল, যাদেরকে প্রয়োজনে অবাধ্য রায়ত বা প্রজাদের অনুগত করার কাজে ব্যবহার করা হতো। প্রতিটি গ্রামে একজন মণ্ডল থাকতো, যার মাধ্যমে খাজনা আদায় করা হতো। জমির খাজনা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে মাঝেমাঝে প্রত্যেকটি গ্রাম জরিপের ব্যবস্থা ছিল। বাংলার অন্যান্য জমিদারের মত ভাওয়াল রাজ সাধারণভাবে কোন মধ্যস্বত্বভোগী রায়ত (প্রজা) সৃষ্টি করেননি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সি.এস রেকর্ডে দেখা যায় উপরিস্বত্ব ভাওয়াল রাজের এবং নিম্নস্বত্ব সরাসরি রায়তের বা ভূমি মালিকের।
    ভাওয়াল জমিদারির প্রধান কাচারি ছিল জয়দেবপুরে। এই কাচারিতে রাজার জন্য বিশেষ একটি আসন বা গদি রক্ষিত ছিল। জমিদারির প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তাকে দিউয়ান বলা হতো। যার অধীনে ছিল একজন উপ-দিউয়ান, কয়েজন নায়েব ও গোমস্তা। জমিদারির বিভিন্ন এলাকার জন্য দিউয়ান খানায় আলাদা আলাদা ডেস্ক ছিল এবং প্রতিটি ডেস্কের জন্য বিভিন্ন ধরণের বেশ কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল।

    ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন বলে ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটলেও আইনগত জটিলতার কারণে ভাওয়াল এস্টেটের কিছু কিছু সম্পত্তি এখনও কোর্ট অব ওয়ার্ডস ভাওয়াল রাজ এস্টেট নামে বাংলাদেশ সরকার ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ভূমি সংস্কার বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনা করছেন।

    Related Post:


  • You might also like

    No comments:

    Post a Comment

Popular Posts