ভাওয়াল থেকে গাজীপুর
(সন্ন্যাসী রাজা)
(সন্ন্যাসী রাজা)
Raja Ramedra Narayan Ray |
দার্জিলিং পর্বের বারো বৎসর পর ১৯২১ সালের ৪ঠা মে। ঢাকা শহরের বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সারি সারি গাছ ও বাগান বেষ্টিত মনোরম বাকল্যাণ্ড বাঁধে আত্মপ্রকাশ ঘটে দীর্ঘ জটাধারি শশ্রুমণ্ডিত, ভস্মাচ্ছাদিত গেরুয়াধারী এক সন্ন্যাসীর। বাকল্যান্ড বাঁধ তখন সাহেবদের মর্নিং ও ইভনিং ওয়াকের স্থান। সন্ন্যাসী আস্তানা গাড়েন তখনকার ব্যবসায়ী রূপলাল দাসের অট্টালিকার সামনে। এই অট্টালিকা এখনো রাছে, তবে তা এখন সব্জীর আড়ৎ। গৌরবর্ণ কান্তি, সম্ভ্রান্ত চেহারা নজর কাড়ে সবার। গুঞ্জন উঠে ভাওয়ালের মেজকুমার সন্যাসী হয়ে ঢাকায় ফিরে এসেছেন, ভীড় বাড়তে থাকে। এই গুঞ্জন এক সময় পৌঁছে রাজ পরিবারে।
কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায় চৌধুরি সন্ন্যাসীকে তার জমিদারিতে নিয়ে আসেন। সেখানে ধনী-গরীব, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভিড় লেগে যায়। যারা মেজকুমারকে কাছ থেকে চেনেন তারা তো অবাক। মানুষে মানুষে এত মিল হয় নাকি! আগন্তুকের গেরুয়া বেশ আর মুখভর্তি দাড়ি থাকলেও তারা নিশ্চিত এ-ই তাদের ‘মৃত’ মেজ কুমার। লোকজন আহ্লাদ ভরে সন্ন্যাসীর হাত-পা মুখ ছুঁয়ে দেখেন।
কুমারদের দিদি জ্যোতির্ময়ী দেবী সন্ন্যাসীকে আনতে পাঠান তাঁর পুত্রকে। সন্ন্যাসীকে নিয়ে আসা হয় জ্যোতির্ময়ী দেবীর বাড়ি। সন্ন্যাসীর মুখ যেন একেবারে কেটে বসানো ভাইয়ের মুখ। জ্যোতির্ময়ী লক্ষ করেন তার ভাইয়ের মত সন্ন্যাসীরও খাওয়ার সময় ডান হাতের তর্জনি আলগা হয়ে যায়, জিহ্বা সামনে বেরিয়ে আসে। জ্যোতির্ময়ী ভাইয়ের আগের একটি ছবি সন্যাসীর সামনে এনে ধরেন। দুজনের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে। উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন ও কৌতুহলি লোকজন সন্ন্যাসীর পরিচয় নিশ্চিত হতে রীতিমত পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেন। জমিদার পারিবারের খুঁটিনাটি বিষয়- তার বাবার নাম, মায়ের নাম, এমনকি যে ধাইমার কাছে মেজকুমার বড় হয়েছেন তার নাম পরিচয় কিছুই বাদ যায় না। সন্যাসী পরীক্ষায় সহজেই উত্তীর্ণ হন। কারণ এই যে প্রকৃত মেজকুমার।
দিন দিন সন্ন্যাসীকে ঘিরে লোকজনের কৌতুহল ও চাপ বাড়তে থাকে। ডালপালা মেলতে থাকে নানামুখি গুজবের। যাকে নিয়ে এত চাঞ্চল্য সেই সন্ন্যাসীর মুখ থেকে কথা বের হয় কমই। নিজ পরিচয় প্রশ্নে তিনি প্রচন্ড রকম নির্লিপ্ততা দেখান। লোকজনের কৌতুহল প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। মুখে গ্রাস তোলার সময় বেরিয়ে থাকা ডান হাতের তর্জনী, একটু বেরিয়ে আসা জিভ, মুক্তোর মতো পরিপাটি সাদা দাঁত – অবিকল মেজকুমার। এতো মিল হয় কি ভাবে? প্রয়াত ছোট কুমারের ফটো দেখে চোখ ঢেকে সন্ন্যাসী কাঁদতে থাকে মাটিতে শুয়ে। দার্জিলিঙে মেজকুমারের মৃত্যু প্রসঙ্গ শুরু করলে সন্ন্যাসী বলে উঠলেন, “না, না, তাঁর দেহ পোড়ানো হয়নি। তিনি জীবিত আছেন।” অনেকটা পেরেশান হয়ে অন্য সন্ন্যাসীদের নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ তীর্থে চলে যান। কিছুদিন কাটিয়ে ফিরে আসেন ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধে।
কুমারদের দিদি জ্যোতির্ময়ী দেবী সন্ন্যাসীকে আনতে পাঠান তাঁর পুত্রকে। সন্ন্যাসীকে নিয়ে আসা হয় জ্যোতির্ময়ী দেবীর বাড়ি। সন্ন্যাসীর মুখ যেন একেবারে কেটে বসানো ভাইয়ের মুখ। জ্যোতির্ময়ী লক্ষ করেন তার ভাইয়ের মত সন্ন্যাসীরও খাওয়ার সময় ডান হাতের তর্জনি আলগা হয়ে যায়, জিহ্বা সামনে বেরিয়ে আসে। জ্যোতির্ময়ী ভাইয়ের আগের একটি ছবি সন্যাসীর সামনে এনে ধরেন। দুজনের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে। উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন ও কৌতুহলি লোকজন সন্ন্যাসীর পরিচয় নিশ্চিত হতে রীতিমত পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেন। জমিদার পারিবারের খুঁটিনাটি বিষয়- তার বাবার নাম, মায়ের নাম, এমনকি যে ধাইমার কাছে মেজকুমার বড় হয়েছেন তার নাম পরিচয় কিছুই বাদ যায় না। সন্যাসী পরীক্ষায় সহজেই উত্তীর্ণ হন। কারণ এই যে প্রকৃত মেজকুমার।
দিন দিন সন্ন্যাসীকে ঘিরে লোকজনের কৌতুহল ও চাপ বাড়তে থাকে। ডালপালা মেলতে থাকে নানামুখি গুজবের। যাকে নিয়ে এত চাঞ্চল্য সেই সন্ন্যাসীর মুখ থেকে কথা বের হয় কমই। নিজ পরিচয় প্রশ্নে তিনি প্রচন্ড রকম নির্লিপ্ততা দেখান। লোকজনের কৌতুহল প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। মুখে গ্রাস তোলার সময় বেরিয়ে থাকা ডান হাতের তর্জনী, একটু বেরিয়ে আসা জিভ, মুক্তোর মতো পরিপাটি সাদা দাঁত – অবিকল মেজকুমার। এতো মিল হয় কি ভাবে? প্রয়াত ছোট কুমারের ফটো দেখে চোখ ঢেকে সন্ন্যাসী কাঁদতে থাকে মাটিতে শুয়ে। দার্জিলিঙে মেজকুমারের মৃত্যু প্রসঙ্গ শুরু করলে সন্ন্যাসী বলে উঠলেন, “না, না, তাঁর দেহ পোড়ানো হয়নি। তিনি জীবিত আছেন।” অনেকটা পেরেশান হয়ে অন্য সন্ন্যাসীদের নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ তীর্থে চলে যান। কিছুদিন কাটিয়ে ফিরে আসেন ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধে।
সন্ন্যাসীকে পুনরায় রাজবাড়িতে আনা হয়। একদিন নদীতে স্নান সেরে ছাই না মেখে ফিরলে দেখা গেল উজ্জ্বল গৌরবর্ণ চেহারা, শরীরে আরো পরিচিত চিহ্ন। এবার শুধু জ্যোতির্ময়ী নন, তাঁদের ঠাকুমা ও (বাবার মা, যিনি তখনো জীবিত) চিনতে পারলেন, সন্ন্যাসীই মেজ কুমার। ঠিক বারো বছর আগ প্রায় একই দিনে, তথাকথিত মৃত্যু হয়েছিল মেজ কুমারের, দার্জিলিংয়ে।
পরিচয় না দিলে জলগ্রহণ করবেন না বললেন জ্যোতির্ময়ী দেবী। ততোক্ষণে জড়ো হয়েছে হাজার দুয়েক প্রজা। জেরার মুখে সন্ন্যাসী বলে দিল তাঁর ধাই মা এর নাম ‘অলকা'। উল্লাসে ফেঁটে পড়লো জনতা, জয়ধ্বনি দিতে লাগল, “জয়, মধ্যমকুমারের জয়”, মেয়েরা দিতে লাগলো উলুধ্বনি।
কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায় চৌধুরি সন্যাসীকে পুনরায় তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। এখানে ভাওয়াল পরগনার অধীন সব জমিদার এবং মেজকুমারের অতি পরিচিতজনদের ডাকা হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় পরবর্তী করনীয় নিয়ে। সন্যাসীকে ঘিরে এ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, পাঁচ জন হিন্দু জমিদার, একমাত্র মুসলিম জমিদার মৌলভী মুহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন আহম্মেদ খাঁন আব্দু মিয়া, কালীগঞ্জের বেরুয়া গ্রামের তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ প্রেসিডেন্ট ডা. সামসুদ্দিন আহম্মেদসহ আরো কয়েজন উচ্চমার্গীয় ব্যক্তিবর্গ। এ সভায় গ্রহন করা সিদ্ধান্ত অনুসারেই এগোতে থাকে পরবর্তী কর্মকান্ড। যদিও মেজকুমারের পক্ষ অবলম্বন করায় রোষানলের শিকার হতে হয়েছিল ভাওয়াল পরগনার একমাত্র মুসলিম জমিদার মেজবাহউদ্দিন আহম্মেদ খাঁন আব্দু মিয়াকে। কিন্তু ভীষণ সাহসী এ জমিদার রানীর কাছে কোন ভাবেই মাথানত না করে বরং বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। সভার সিদ্ধান্তানুসারে হাতিযোগে সন্ন্যাসী মেজকুমারকে নিয়ে ছোটেন জয়দেবপুরের রাজবাড়ির দিকে। তাদের বহরের পিছু নেয় উৎসাহী জনতা। জয়দেবপুর পর্যন্ত আসতে আসতে কাফেলা রীতিমত জনস্রোতে রূপ নেয়।
রাজবাড়ির সামনে কামিনী গাছের নিচে বসেন সন্ন্যাসী। হাজারো লোকের কৌতুহল তাকে ঘিরে। সমবেত লোকজনের সামনে রাজবাড়ির চিকিৎসক আশুতোষ দাস গুপ্ত সন্ন্যাসীকে তাদের দার্জিলিং অবস্থানকালীন একটি ঘটনার বিষয়ে প্রশ্ন করেন। সঠিক জবাব দিয়ে সন্ন্যাসী তার দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ দেন। প্রমাণ যত অকাট্যই থাক, মেজকুমারকে মেনে নেওয়া গুটিকয়েক লোকের জন্য সম্ভব ছিল না। এদের মধ্যে অন্যতম কুমারের স্ত্রী বিভাবতীর (মেজরাণীর) ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। কারণ, তিনি ইতোমধ্যে মেজকুমারের জীবন বীমার ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া মেজকুমারের স্ত্রী হিসাবে বিভাবতী জমিদারির পক্ষ থেকে বাৎসরিক লক্ষাধিক টাকার যে ভাতা পেতেন তার পুরোটাই গ্রহণ করতেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাই মেজকুমারের ফেরা সত্যেন্দ্রনাথের জন্য হলো অশনি সংকেত।
ভাওয়াল এস্টেটের ম্যানেজার নিডহ্যাম গোপন রিপোর্ট পাঠান ঢাকার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট লিণ্ডসে-কে, “দিন দিন বাড়ছে মেজকুমার ঘোষণাকারী সন্যাসীর অনুসারী, প্রতিদিন দেখতে আসছে পাঁচ ছয় হাজার লোক, ‘নজরানা’ ও দিচ্ছে কেউ কেউ। প্রজারা দুই লাখ টাকা চাঁদা দেবে তাঁর সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের জন্য। জনরোষের ভয়ে প্রতিবাদ ও করা যাচ্ছে না।”
এস্টেটের তহবিল নয়-ছয় করায় ক্ষোভ ছিল প্রজাদের। মেজকুমারের সগৌরব প্রত্যাবর্তন তাদের নিকট যোগ্য প্রতিকার। প্রকাশ্য সমাবেশের ডাক দেওয়া হয় জয়দেবপুর রাজবাড়ির সামনের ময়দানে। ভোর হতে না হতে নামে মানুষের ঢল। রেল কোম্পানি স্পেশাল ট্রেন চালু করা সত্ত্বেও ট্রেনে ঝুলতে ঝুলতে স্রোতের মতো আসে অজস্র মানুষ ।
উপস্থিত জনসমুদ্রে সমস্ত ঘটনা বলে সমবেত জনতাকে উদ্দেশ্য করে, “সন্যাসীই ভাওয়ালের মেজকুমার” বিশ্বাস করলে হাত তুলতে বলা হলে হাজার হাজার সমবেত জনতা হাত উঠালো ঊর্দ্ধাকাশে। অবিশ্বাসীদেরকে হাত উঠাতে বললে হাত উঠালো না একটাও। দিগন্তে ঢলে পড়ছে সূর্য। হাতির পিঠে চড়ে সন্যাসী প্রদক্ষিণ করেন সভামঞ্চ। উল্লাসে ফেঁটে পড়ল জনতা। ‘জয়, মধ্যমকুমার কী জয়’। হঠাৎ দমকা বাতাস, ধুলোর কালবৈশাখী ঝড় ও প্রবল বৃষ্টি। সভা ভেঙে গেল।
মির্জাপুর হাট। জে এইচ লিণ্ডসের লোকজন ঢোল বাজিয়ে প্রচার করছে – সন্যাসী প্রতারক। তাঁকে যেন খাজনা অথবা চাঁদা না দেয়া হয়। প্রজারা ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি চালালে মৃত্যু বরণ করে গুলিবিদ্ধ প্রজা ঝুমর আলি।
প্রজাদের অধিকাংশই ছিল মুসলিম এবং তখন শুরু হয়েছে জমিদারি প্রথা বিলোপ চেয়ে প্রজা আন্দোলন । কিন্তু ফরিয়াদি মেজকুমারের সমর্থনে সাক্ষী হিসেবে আদালতে হাজির হয়েছিল অসংখ্য মুসলিম প্রজা ও প্রজা আন্দোলনের নেতারা। ডজন ডজন পুস্তিকা লিখেছিলেন আর গান বেঁধেছিলেন মুসলমান লেখক আর কবিরা।
ঐতিহ্যগত ভাবে প্রজাদের ছিল রাজপরিবারের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা আর কোর্ট অব ওয়ার্ডের প্রতি বিরাগ। ফরিয়াদী মেজকুমার তাই সহানুভূতি পান সর্বস্তরের প্রজাদের। ছুটে আসতো কষ্ট স্বীকার করে দূর-দূরান্ত থেকে। চাষীদের বিরাট অংশই নিশ্চিত ছিল যে আসামীই রাজকুমার। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে গিয়ে এক প্রজার চোখে পড়ে সন্যাসীর গোড়ালির কাছে ওঠা-ওঠা খানিক চামড়া । এতে সন্দেহই থাকে না সন্যাসী যে রাজকুমার।
প্রজারা বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ কালেক্টরকে খাজনা দেওয়া । কোলকাতা হতে আনা হয় রাণী বিভাবতী দেবী-কে। বোঝাতে চেষ্টা করেন “এই সন্যাসী মেজকুমার নন”। ভাওয়াল রাজবংশে পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকায় কোর্ট অব ওয়ার্ডস অনুযায়ী জমিদারি সরকারের। সরকার এখন বিপাকে নতুন করে প্রকৃত মালিকের উদয়ে। বিচলিত সরকার তাই উদগ্রীব সন্যাসীকে ‘ভন্ড’ প্রমাণ করা নিয়ে।
Related Post:
No comments:
Post a Comment